নন্দী ডেস্ক:
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া কিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢালাওভাবে মামলা বাণিজ্য চলার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে—২০২৩ সালের জুলাই মাসে পুরান ঢাকায় নাদিমুল হাসান নামে এক ছাত্র নিহত হওয়ার পর তার হত্যা মামলায় নানা ধরনের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে আসামি করা হচ্ছে অসংখ্য নিরপরাধ ব্যক্তিকে, এবং মামলার তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে টাকা দাবি করার অভিযোগও রয়েছে।
গত ১৯ জুলাই, পুরান ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন নাদিমুল হাসান এলেম। এই ঘটনায় তার মা কিসমত আরা ৮৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলার বাদী কিসমত আরা জানান, যাদের নাম মামলায় রয়েছে, তাদের অধিকাংশকে তিনি চেনেন না। তিনি বলেন, আমিও তো ওদেরকে চিনি না। যাদের মাধ্যমে মামলাগুলো করেছি, তারা এই নামগুলো দিয়েছে।
অথচ, নাদিমুল হাসানের মৃত্যুর সময় তার সঙ্গে আন্দোলন করছিলেন সুলতানা আক্তার, তার বাবাকে মামলার আসামি করা হয়। সুলতানা বলেন, যে ছেলে আমার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল, তার মামলায় আমার বাবাকে কেন আসামি করা হলো? এটা তো অবিশ্বাস্য! ওই দিন আমি ছিলাম তার এক হাত দূরে। গুলি যদি তার গায়ে না লাগতো, আমার গায়ে তো লাগতে পারতো।
এই পরিস্থিতি সুলতানা আক্তারের কাছে অত্যন্ত অবিশ্বাস্য এবং দুর্বিষহ। তিনি আরও জানান, রাজনৈতিক বা কোনো অন্য উদ্দেশ্য না থাকলেও, ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে তার বাবাকে মামলা দিয়ে জড়ানো হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
টাকা দাবি ও মামলা বাণিজ্য
মামলা থেকে আসামি বাদ দেওয়ার জন্য টাকা চাওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। সুলতানা আক্তার জানান, তিনি যখন আসামির তালিকা থেকে তার বাবার নাম বাদ দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন, তখন মামলার বাদী শাহ আলম তিন লাখ টাকা দাবি করেন। সুলতানা বলেন, আমি বললাম, আমি তো একজন ছাত্র আন্দোলনের সদস্য। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এই টাকা না হয় যোগাড় করতে পারব। কিন্তু তিনি বললেন, তিন লাখ টাকা নিয়ে আসুন, আমি ব্যবস্থা করব।
সুলতানা আরও জানান, মামলার বাদী শাহ আলম পরে দাবি করেন, ২০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে আরও সাত লাখ টাকা দাবি করা হয় এবং মোট ২৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এরপরও তার বাবার নাম বাদ দেওয়া হয়নি, বরং আরও মামলা করা হয়েছে।
এক ব্যক্তি, যিনি এসব ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন, জানান, তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যহীনভাবে মামলা করা হয়েছে এবং টাকা না দিলে মামলার ভয় দেখানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এভাবে টাকা আদায়ের জন্য আমাকে এবং আরও অনেককে টার্গেট করা হয়েছে।
সরকারের পদক্ষেপ
মামলা বাণিজ্য নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ইতিমধ্যেই এই বাণিজ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভুয়া মামলা বা মিথ্যা মামলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩০ ডিসেম্বর তিনি বলেন, মামলা নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে, মামলায় ভুল আসামিদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, এবং এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হবে।
তিনি আরও জানান, সরকার মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য লিগ্যাল এইড সেল তৈরি করার পরিকল্পনা করছে, যাতে বিচারকের কাছে সঠিকভাবে মামলা করা যায়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে যাতে কেউ মামলার ব্যাপারে ভুল পথে না চলে, সে জন্য সরকার নানাভাবে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছে।
অধ্যাপক নজরুল আরও বলেন, এ ধরনের মামলা বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে, সবার আগে আমাদের সঠিকভাবে মামলা করতে হবে। আমরা এই বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লিগ্যাল এইড সেল তৈরি করব।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক বলেছেন, এই ধরনের ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়, আমাদের সমাজে মামলা বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরকম মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে, যা খুবই নিন্দনীয়। তিনি আরও যোগ করেন, বিষয়টি তদন্ত করা কঠিন কিছু নয়। যদি একজন বাদী অভিযোগ করে বলেন, তিনি আসামিদের চেনেন না, তাহলে ওই মামলাটি পরীক্ষা করে বের করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের উচিৎ, মডেল থানাগুলোর মাধ্যমে এই বাণিজ্য বন্ধ করা। কিছু মডেল থানায় মামলা বিষয়ক শুদ্ধতা নিশ্চিত করা যেতে পারে, যা অন্য থানায় ছড়িয়ে পড়বে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে বাস্তবতার চিত্র এখনও পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ দেখা যায়নি, কিন্তু এসব অব্যাহত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, সুশীল সমাজ, আইনজীবী এবং সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
অধ্যাপক নজরুলের কথায়, এ ধরনের অবস্থা বন্ধ করতে সরকার কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং অভিযুক্তদের সঠিকভাবে শাস্তি দেওয়া হবে। তবে, এ পর্যন্ত সঠিক তদন্ত এবং শাস্তির পদক্ষেপের অভাব লক্ষ্য করা গেছে, যা এই পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।