নন্দী ডেস্ক: বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে ২৬টি ক্যাডারের নিয়োগ প্রক্রিয়া একই হলেও বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার সার্ভিস থেকেই প্রায় মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান সচিব বা সিনিয়র সচিব হয়ে থাকেন। বাকী ২৫টি ক্যাডার থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পর্যন্ত হতে পারেন। অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডার ২৬টি ক্যাডারের একটি হলেও বাকী ২৫টি ক্যাডারকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করছে।
বর্তমানে ৯টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে। এর মধ্যে একটি হল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের প্রধান কাজ ২৬টি ক্যাডারের বৈষম্য হ্রাস করে জনপ্রশাসনকে জনগণের সেবাবান্ধব করে সেবা সহজিকরণ করা এবং জনপ্রশাসনকে জনগণমুখী করে গড়ে তোলা। কিন্তু জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের একটি প্রেস ব্রিফিং জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
এরপর থেকে দুইটি বিষয় নিয়ে সমালোচনা চলছে। ক) (১) বিসিএস ( সাধারণ শিক্ষা) এবং (২) বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার সার্ভিসকে ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে নিয়ে পৃথক সার্ভিস গঠন করা; খ) সিনিয়র সার্ভিস পুল (উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব এবং সিনিয়র সচিব) পদে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ভোগকৃত ৭৫% কোটা হ্রাস করে ৫০% এবং অন্যান্য ২৫টি ক্যাডারের ভোগকৃত ২৫% কোটা বৃদ্ধি করে ৫০% এ উন্নীত করে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি প্রদান করার প্রস্তাব করা হবে।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের দাবি উপসচিব পদে তাদের ১০০% কোটাই সংরক্ষণ করতে হবে এবং কোন প্রকার লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে না। অপরদিকে অন্যান্য ২৫টি ক্যাডার দাবি করছে কোটা বাতিল করে ১০০% উন্মুক্ত করে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব পদে নিয়োগ প্রদান করতে হবে এবং অতীতের ধারাবাহিকতায় বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) এবং বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারকে ক্যাডারের মধ্যেই রাখতে হবে।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার দাবি করেছেন উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো তাদের সহজাত ও লাইন পোস্ট! অন্যান্য ২৫ ক্যাডার দাবি করেছেন উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো সরকারের বিশেষ পদ; এই পদ কোন ক্যাডারের সহজাত বা লাইন পোস্ট নয়। এ কারণে এই পদে মেধার ভিত্তিতে কোটা বিলোপ করে নিয়োগ দিতে হবে।
উপসচিব থেকে সচিব বা সিনিয়র সচিব পর্যন্ত পদগুলোর অধিকাংশ বর্তমানে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার থেকে নিয়োগের কারণে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের কী কী সমস্যা হচ্ছে এই বিষয় বিবেচনা করা দরকার।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণে সকল মন্ত্রণালয়ের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে ২৬টি ক্যাডারের ২৫টি ক্যাডারের কমপক্ষে ৫২ হাজার ৯২৪ জন কর্মকর্তা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ফলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশাসনিক ক্ষমতা ও আর্থিক ক্ষমতা, ক্যারিয়ার প্লানিং , বেতন ও ভাতা , পে-স্কেলে গ্রেডিং, প্রেষণ-লিয়েন সুবিধা, পদায়ন, বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, বদলি পদায়নের টার্নওভার , পদক্রম, পদোন্নতি, সরকারের সাথে সিভিল সার্ভিসের আন্তঃসম্পর্ক অর্গানোগ্রাম, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, উচ্চতর শিক্ষা সুযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করছে।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার সার্ভিসের নিয়োগের ৪৪% মেধা কোটায় হলেও ৫৬% কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন কোটায় প্রাধিকারের ভিত্তিতে। ফলে অন্যান্য ক্যাডারের মেধায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মেধাতালিকায় প্রথম দিকে থাকার পরেও কোটার কারণে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে জায়গা পান নাই, তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্য ক্যাডারে। অথচ মেধাবী কর্মকর্তা অধিক নম্বর প্রাপ্ত হয়েও কোটার কারণে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পান নাই। অথচ প্রাধিকার কোটায় অনেক কম নম্বর প্রাপ্ত হয়েও কমপক্ষে ৫৬% কর্মকর্তা বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন তফশিল ভুক্ত পদের জন্য।
এই অধিকার হরণ করার কারণে একটি ক্যাডার তথা বিসিএস প্রশাসন সকল ক্ষমতা ভোগ করছে। এ কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রশাসন মেধা শূন্য হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টাডি বলছে বিশ্বের সবচেয়ে এফিসিয়েন্ট ব্যুরোক্রেটিক টিম হলো সুইজারল্যান্ড; এবং এফিসিয়েন্ট ব্যুরোক্রেটিক টিম হিসেবে বাংলাদেশ ৮৯টি দেশের মধ্যে ৭১তম! যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা বলছে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন্ডেক্সের তালিকায় বাংলাদেশ ১১৮টি দেশের মধ্যে ৯৩তম! পাবলিক লিডারশিপের ইন্ডেক্সে বাংলাদেশ ১২০টি দেশের মধ্যে ৯৩তম।
বিশ্বাস ও মর্যাদায় ১২০টি দেশের মধ্যে আমরা ১১২তম। ব্যুরোক্রেটিক সিস্টেমে ১২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ৯৩তম; আইন ও পলিসি মেকিং এ আমরা ১১৩টি দেশের মধ্যে ৯৮তম; এই ইন্ডেক্স মাঠপর্যায়ে তথ্য আরো শোচনীয়। মূলত একটি ক্যাডারের অধিক ক্ষমতা ভোগ ও সেবায় মনোযোগ না দেওয়ার কারণে আমাদের জনপ্রশাসন জনবান্ধব ও জনগণের সেবামুখী হতে পারে নাই।
কিন্তু সরকারের বিশেষ পদ সিনিয়র সার্ভিসের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব এবং সিনিয়র সচিব পদে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হলে এফিসিয়েন্ট ব্যুরোক্রেটিক টিম গঠন সম্ভব হবে। এফিসিয়েন্ট ব্যুরোক্রেটিক টিম গঠন হলে জনপ্রশাসন জনবান্ধব ও জনগণের মানসম্মত সেবা প্রদানে সক্ষম হবে। অন্যথায় জনপ্রশাসন দিনদিন আরো মেধা শূন্য হবে। মেধা শূন্য জনপ্রশাসন দ্বারা সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া কঠিন।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার থেকে প্রায় সকল উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব নিয়োগ হওয়ায় মেধা শূন্য জনপ্রশাসনের সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার সার্ভিসের একজন ডিসি ৩০২টি কমিটির সভাপতি এবং একজন ইউএনও ১৬৭ কমিটির সভাপতি। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তার হাতে এতগুলো কমিটির সভাপতির পদ থাকলে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে যে কোন ব্যক্তি কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পাদন করতে হিমশিম খাবেন এবং জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। বাংলাদেশে হচ্ছেও তাই। ৩০২টি কমিটির অধিকাংশই তাদের অধিক্ষেত্রের বাBরের বিষয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর যে, শিক্ষক দিবস পালনেও সভাপতি ইউএনও কিংবা ডিসি! ১০/১৫ ব্যাচ সিনিয়র হয়েও বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তারা তাদের সভাপতিত্বে সভা করতে হয়, যা শৃঙ্খলার যেমন সমস্যা করছে তেমন আন্তঃসম্পর্ক নষ্ট করছে। তাতে কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যায়; ফলে জনগণ সেবা পায় না।
আবার অনেক ক্ষমতা ও অনেক কাজ নিজেদের দখলে রাখায় কাজগুলো সঠিক ভাবে হয় না, অন্যরাও কাজগুলো করার সুযোগ পায় না। অপরদিকে এত বেশি কলোনিয়ালিজম এবং ভারসাম্যহীন ক্ষমতা শুধুমাত্র একটি ক্যাডার সার্ভিসকে প্রদানের ফলে তারা অজান্তেই স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হচ্ছেন; নিজের খেয়ালখুশি মতো সিদ্ধান্ত প্রদান করে পেশাদারিত্বকে প্রশ্নে সম্মুখীন করছেন।
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার ও বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার সার্ভিসকে ক্যাডার সার্ভিসের বহির্ভূত করা হলে জনগণের সেবায় কী কী প্রভাব পড়বে? বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সার্ভিসের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা না থাকার পরও অনেক মেধাবী বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সার্ভিসে আসেন মর্যাদার কারণে। ক্যাডার না থাকলে মর্যাদা থাকবে না, চাকুরির নিরাপত্তা থাকবে না, মেধাবীরা এই পেশায় আগ্রহ হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যাবেন কিংবা বিদেশ পাড়ি জমাবে।
মেধা পাচার হবে। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৮০% উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর এবং কমপক্ষে ৬৫% উচ্চ শিক্ষায় পড়ুয়াদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তাদের পরফমেন্সে শিক্ষা পরিবারের অভিভাবকগণ আজও চোখ বন্ধ করে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার দ্বারা পরিচালিত ও পাঠদানকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা করেন।
মেধাবীরা এই পেশায় বিমুখ হলে এই ভরসার জায়গা নষ্ট হয়ে যাবে; শিক্ষাখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে চাকুরিতে আছেন এই শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে ক্যাডার থাকায় চাকুরি করছেন। ক্যাডার থেকে তাদের বাদ দেওয়া হলে বড় অংশ স্বেচ্ছায় অবসরে চলে যেতে পারেন। বর্তমানে দীর্ঘ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মেধাবী শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু; বিপিএসসি থেকে বের করে কমিশনের মাধ্যমে শর্টকাট পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করা হলে শিক্ষার গুণগত মান আরো নিম্ন হবে, দক্ষ শিক্ষক পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে বর্তমানে যে ভারসাম্যহীন অবস্থা দেখা যাচ্ছে অন্যদের ক্যাডারে রেখে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ও বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারকে ক্যাডার সার্ভিস থেকে বের করে দেওয়া হলে আরো ভারসাম্যহীন হয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির সম্ভাবনা আছে।